নজরবন্দী বা ভেল্কিবাজি জাদুর রুকইয়াহ

নজরবন্দি বা দৃষ্টিভ্রম যাদুর পরিচয়
আরবীতে এপ্রকারের যাদুকে বলা হয় সিহরুত তাখয়ীল(سحر التخييل) বা তাখাইয়্যুল (التخيل)। এর অর্থ হচ্ছে দৃষ্টিভ্রম করা বা চোখে ধাঁধা লাগানো। এ যাদুর মাধ্যমে এক বস্তুকে অন্য বস্তু হিসেবে দেখানো হয়। বাস্তবে বস্তুটির এক রূপ কিন্তু মানুষ দেখতে পায় অন্য রূপে। যেমন লাঠিকে সাপ, কাগজকে টাকা, ফুলকে পাখি, ছোট কে বড়, কোনো স্থীর বস্তুকে চলমান, রসুনকে দাঁত, পাথরকে ছাগল রূপে দেখতে পাওয়া, ইত্যাদি।

এ ধরনের যাদুর ফলে ভিক্টিমের মাঝে এক ধরনের হ্যালোসিনেশন সৃষ্টি হয়; যার ফলে সে এক জিনিসকে অন্য জিনিস হিসেবে দেখতে পায়, যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন ধরনের অসংলগ্ন ও অদ্ভুত আচরণও রোগীর মাঝে প্রকাশ পেতে পারে। এ প্রকারের যাদুতে যাদুকররা সরাসরি জ্বীনের সাহায্য নেয়।

এ ধরনের যাদুর রোগীদেরকে ডাক্তাররা বা মেডিক্যাল পরিভাষায় সিজোফ্রেনিয়ার রোগী বলে আখ্যায়িত করে। এরকম সমস্যা যেমন যাদুর কারণে হতে পারে তেমনি সিজোফ্রেনিয়ার কারণেও হতে পারে। আধুনিক যুগে অনেকেই এ ধরনের সমস্যাকে জ্বীন জাদুর কারণে হয়েছে বলে মানতে চায় না। মনে কে এটা ডাক্তারি সমস্যা বা সিজোফ্রেনিয়া। তবে এ ধরনের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে সবাই যে জ্বীন জাদুর রোগী তা নয়; তেমনি সবাই যে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগ বিষয়টি তা-ও নয়। বরং সঠিক ডায়াগনোসিস করে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা আবশ্যক।

এ প্রকার যাদুর কথা কোরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে। মূসা আঃ এর সামনে জাদুকররা যে জাদু প্রদর্শন করেছিল সেটা এ পর্যায়ের জাদুই ছিল। আর এটিই আল্লাহ তাআলা কোরআনে উল্লেখ করেছেন।

সূরা আরাফে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِمَّا أَنْ تُلْقِيَ وَإِمَّا أَنْ نَكُونَ نَحْنُ الْمُلْقِينَ، قَالَ أَلْقُوا فَلَمَّا أَلْقَوْا سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوا بِسِحْرٍ عَظِيمٍ، وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ مُوسَىٰ أَنْ أَلْقِ عَصَاكَ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ، فَوَقَعَ الْحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ، فَغُلِبُوا هُنَالِكَ وَانْقَلَبُوا صَاغِرِينَ، وَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ، قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ، رَبِّ مُوسَىٰ وَهَارُونَ

যাদুকররা বলল, হে মূসা আপনি (প্রথম) নিক্ষেপ করবেন না হয় আমরা নিক্ষেপ করব। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, নিক্ষেপ কর। এরপর যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন লোকদের দৃষ্টিকে যাদু করল এবং তাদেরকে ভীত করে তুলল। আর আমি মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে নির্দেশ দিলাম যে, আপনি আপনার লাঠিটি নিক্ষেপ করুন। অতঃপর মুহুর্তেই সেই লাঠি (সাপে পরিণত হয়ে) তাদের সমস্ত যাদু বস্তুগুলো গিলে ফেলল। অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হল আর তাদের কৃতকর্ম ধ্বংস হয়ে গেল। সেখানেই তারা পরাজিত হল এবং তারা লাঞ্ছিত হল। আর যাদুকর সকলেই সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। তারা বলল আমরা বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থান করেছি মূসা ও হারুণের প্রভুর প্রতি ঈমান এনেছি। (সূরা আরাফঃ ১১৫-১২২)

আর সূরা ত্বা-হায় আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِمَّا أَنْ تُلْقِيَ وَإِمَّا أَنْ نَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَلْقَىٰ، قَالَ بَلْ أَلْقُوا فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَىٰ

অর্থঃ “ তারা (যাদুকরেরা) বলল হে মূসা আপনি নিক্ষেপ করো না হয় আমরাই প্রথমে নিক্ষেপ করি। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন বরং তোমরাই প্রথম নিক্ষেপ কর। অতঃপর মুহুর্তেই তাদের যাদুর প্রভাবে মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট মনে হলো তাদের রশি ও লাঠিগুলো (সাপ হয়ে) ছুটাছুটি করছে। (সূরা ত্বা-হাঃ ৬৫,৬৬)

মূলত রশি লাঠি আপন অবস্থাতেই ছিল। কিন্তু দেখে উপস্থিত সকল জনতা সহ মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে মনে হচ্ছিল এইগুলো সাপে পরিণত হয়ে গেছে। এটাই হলো দৃষ্টিভ্রম বা চোখে ধাঁধা লাগানোর জাদু।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ করুন, জাদুরকররা জাদুমন্ত্র ও জ্বীনের সাহায্যে আল্লাহ তাআলার একজন নবীর চোখে জাদু করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে তিনি এক বস্তুর জায়গায় অন্য বস্তু দেখেছেন। শুধু তাই নয় মূসা আলাইহি সালাম এতে মানবীয় ভয়েরও শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُّوسَىٰ (٦٧) قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنتَ الْأَعْلَىٰ (٦٨)
অর্থ: তখন মুসা তার অন্তরে ভয় অনুভব করতে লাগলো।(৬৭) আমি বললাম, ভয় করো না, তুমিই তো বিজয়ী। (৬৮)

সুতরাং পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো দৃষ্টিভ্রম বা চোখে ধাঁধা লাগানোর জাদু সত্য। একটু মিথ্যা বানোয়াট কিছু নয়। জাদু দ্বারা যেখানে একজন পয়গম্বরকে পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পেরেছিল, সেখানে আমাদের মত সাধারণ মানুষদেরকে আক্রান্ত করা তো আরো সহজ। অতএব আমাদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, জ্বীন জাদুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সুস্থতার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ভয় পাওয়া যাবেনা। বরং সাহস করে গুরুত্ব দিয়ে রুকইয়াহ’র যুদ্ধ করতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা সমস্ত জাদুটোনা বাতিল করে দিবেন। আর মুমিনরাই বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।

দৃষ্টিভ্রম যাদুর লক্ষণসমূহ
১। কোন স্থিতিশীলবস্তুকে চলমান, আর চলমান বস্তুকে স্থীর দেখতে পাওয়া।
২। ছোট বস্তুকে বড় আর বড় বস্তুকে ছোটকে দেখতে পাওয়া।
৩। একটি বস্তুকে আসল রূপ থেকে অন্য রূপে দেখতে পাওয়া। যেমনঃ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সময়কালে মানুষ ও মুসা আলাইহি সালাম যাদুর দ্বারা রশি আর লাঠিকে সাপের রূপে দেখতে পেয়েছিল।

এই যাদু কিভাবে করা হয়?
যাদুকর সাধারণ বা সবার কাছে পরিচিত কোন বস্তু সামনে নিয়ে আসে। অতঃপর নিজে কুফরী শিরকি যাদুমন্ত্র পড়ে শয়তানের কাছে প্রার্থনা করে। অতঃপর শয়তানের সাহায্যে সেই বস্তুটি অন্য কোন রূপ দিয়ে দেখানো হয়।

এসবের উদ্দেশ্য হল মানুষকে অবাক করে তাদের থেকে অর্থ লুটিয়ে নেয়া।

কখনও আবার যাদুকর এই প্রকার যাদুকে অন্য প্রকার যাদুর জন্যে কাজে লাগায়।
যেমনঃ স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদের জাদুতে স্বামী তার সুন্দরী স্ত্রীকে কুৎসিত রূপে দেখতে পায়। আর স্ত্রী স্বামীকে অসুন্দর দেখতে পায়।

আসক্তকারী বা মহব্বতের যাদুতে কুৎসিত স্ত্রী সুন্দরীরূপে দেখতে পায়। কিংবা স্বামীকে সুন্দর দেখতে পায়।

বিয়ে আটকে রাখার যাদুতে পাত্রী সেই পাত্রী কে অসুন্দর দেখতে পায় আর পাত্রী পাত্রকে অসুন্দর ও আনস্মার্ট দেখতে পায়।

দৃষ্টিভ্রমের যাদু নষ্টের রুকইয়াহ
এই যাদুকে প্রত্যেক এমন নেক কাজ দ্বারা বাতিল করা যায়, যার দ্বারা শয়তানকে তাড়ানো হয়। যেমনঃ

(১) আযান দেওয়া,

(২) আয়াতুল কুরসী পাঠ করা,

(৩) শয়তান বিতাড়িতকারী দু’আ-দরূদ পাঠ করা।

(৪) বিসমিল্লাহ বলা।
তবে শর্ত হচ্ছে এসব কিছু ওযু অবস্থায় করতে হবে।

উল্লেখ্য: এই যাদুর ক্ষেত্রে কেউ উক্ত আমলগুলো করার পরও যদি ভ্রম দূর না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তা আসলে যাদু নয় এবং সেই ব্যক্তিও যাদুকর নয়। বরং তা ভেল্কিভাজি ও হাতের কারসাজি।

তবে যারা দীর্ঘমেয়াদের জন্য বা স্থায়ীভাবে কিংবা অন্য কোনো যাদুর সাথে এই যাদু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং জ্বীন জাদুর মাধ্যমে আসা ব্যতীত অন্য কোনো কারণে এসে এই সমস্যা ঘটায় তাহলে নির্দিষ্ট যাদু বা সমস্যার জন্য রুকইয়াহ’র পাশাপাশি উপরোক্ত রুকইয়াহ করবেন এবং নিচের আয়াত গুলো ও তিলাওয়াত করবেন বা এইগুলোও দিয়েও রুকইয়াহ করবেন।

দৃষ্টিভ্রমের যাদু নষ্টের রুকইয়াহ আয়াত

بسم ألله الرحمن الرحيم
সূরা রূম ৩০
} فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدّينِ حَنِيفاً فِطْرَةَ اللّهِ الّتِي فَطَرَ النّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللّهِ ذَلِكَ الدّينُ الْقَيّمُ وَلَكِنّ أَكْثَرَ النّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ { [الروم:30]
সূরা হাদীদ ২২
} لّقَدْ كُنتَ فِي غَفْلَةٍ مّنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنكَ غِطَآءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ{[الحديد:22]
সূরা হিজর ১৬-১৭
} وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السّمَاءِ بُرُوجاً وَزَيّنّاهَا لِلنّاظِرِينَ * وَحَفِظْنَاهَا مِن كُلّ شَيْطَانٍ رّجِيمٍ{ [الحجر:16-17]
সূরা মুমিন৬৪
} اللّهُ الّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأرْضَ قَرَاراً وَالسّمَآءَ بِنَآءً وَصَوّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مّنَ الطّيّبَاتِ ذَلِكُمُ اللّهُ رَبّكُمْ فَتَبَارَكَ اللّهُ رَبّ الْعَالَمِينَ{ [غافر:64]
সূরা ত্বা-হা ২১
} قَالَ خُذْهَا وَلاَ تَخَفْ سَنُعِيدُهَا سِيَرتَهَا الاُولَىَ{ [طه :21]
সূরা আ’লা ১৩
}سَبّحِ اسْمَ رَبّكَ الأعْلَىَ * الّذِي خَلَقَ فَسَوّىَ * وَالّذِي قَدّرَ فَهَدَىَ{ [الأعلى:13]
সূরা ত্বীন ৪
} لَقَدْ خَلَقْنَا الإِنسَانَ فِيَ أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ{ [التين:4]

শেয়ার করুন -

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top