গতপর্বে কুরআন ও হাদীস থেকে জাদুর অস্তিত্ব ও বাস্তবতা সম্পর্কে দালিলিক আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা গুলো জানার কারণে মনেই কোনো ধরনের সন্দেহ থাকার কথা না। আশাকরি কোনো মুমিন মুসলমানের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এরপরও আমরা কয়েকজন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ উলামায়ে ও সালাফের মতামত উল্লেখ করছি।
১। আবু মুহাম্মদ আল মাকদিসী রাহিমাহুল্লাহ তার কাফি গ্রন্থে বলেছেন, জাদু হচ্ছে এমন তন্ত্রমন্ত্র ও গিঁট যা অন্তর ও শরীরে প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে অসুস্থ হয়ে যায়, মৃত্যুবরণ করে ও স্বামী স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন- তারা এমন জাদুবিদ্যা শিক্ষা অর্জন করতো যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো যায়। (সূরা বাকারাহ ১০২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন- (হে নবী আপনি বলুন, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি) গিঁটে ফুৎকারকারী (জাদুকর) নারীদের অনিষ্ট থেকে। (সূরা ফালাক ৪) যদি জাদুর বাস্তবতা না-ই থাকতো তাহলে আল্লাহ তাআলা তা থেকে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দিতেন না। (ফতহুল মাজীদ, ৩১৪)
২। খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রকৃতিবাদীদের একটি দল জাদুর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। এর বাস্তবতাকে তারা মিথ্যা বলে দাবি করে। এর উত্তর হলো, জাদুর বিষয়টি প্রমাণিত এবং এর বাস্তবতা রয়েছে। আরব, পারসিক, ভারত উপমহাদেশীয় ও এক দল রোমানসহ বিশ্বের অধিকাংশ জাতি “জাদুর অস্তিত্ব আছে” এর উপর একমত। অথচ এরাই হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি এবং সবচেয়ে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান।
আল্লাহ তায়ালা বলেন—
يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ
অর্থঃ “তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দেয়।” (সূরা বাকার ১০২)
আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে তাঁর নিকট জাদু থেকে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আশ্রয় প্রার্থনার দুআ শিক্ষা দিয়ে বলেন—
وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
আরো বলেছেন- (হে নবী আপনি বলুন, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি) গিঁটে ফুৎকারকারী (জাদুকর) নারীদের অনিষ্ট থেকে। (সূরা ফালাক ৪)
তাছাড়াও জাদু সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যা দৃশ্যমান বাস্তব ও অকাট্য বিষয়কে অস্বীকারকারী ছাড়া কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
অনুরূপভাবে ফকিহগণও জাদুকরের শাস্তির বিধান ও তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুতরাং জাদুর যদি কোনো ভিত্তিই না থাকতো তাহলে এটি সর্বজনবিদিত ও ( কুরআন, হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রে ) বহুল আলোচিত বিষয় হতো না। অতএব জাদুকে অস্বীকার করা মূর্খতা এবং জাদুর অস্তিত্ব অস্বীকারকারীর ভিত্তিহীন দাবি খন্ডন করাও অহেতুক ও অনর্থক কাজ। ( শরহুস সুন্নাহ ১২/১৮৭-১৮৮ )
৩। ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন- আহলুস সুন্নাহ এব্যাপারে একমত যে, যাদু সত্য এবং এর প্রভাব রয়েছে। কিছু মুতাযিলা এটি অস্বীকার করে, এবং বলে এটা শুধুই চোখের ভ্রম। (এরপর ইমাম কুরতুবী রহ. মুতাযিলা ফিরকার আক্বিদা খণ্ডন করেছেন) [তাফসিরে কুরতুবী ২/৪৭ দ্রষ্টব্য]
৪। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বিশুদ্ধ মত হলো নিশ্চয় জাদুর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। জমহুর আলিমগণ এটি অকাট্য ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। আর সর্বসাধারণ উলামায়ে কেরামের মতও এটিই। কুরআন ও প্রসিদ্ধ সহিহ হাদিস গুলো এর পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ করে। (রওজাতুত তালিবীন ৯/৩৪৬; ফতহুল বারী ১০/২২২)
৫। আবুল ইয্ হানাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, জাদুর বাস্তবতা ও প্রকারভেদ সম্পর্কে আলিমগণ মতভেদ করেছেন; কিন্তু অধিকাংশ আলিমই বলেন, নিশ্চয়ই জাদুগ্রস্থ ব্যক্তির মৃত্যু ও অসুস্থতার ক্ষেত্রে জাদু প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাকে প্রকাশ্য কোনো কিছু স্পর্শ না করা সত্ত্বেও। (শরহুল আকীদা আততাহাবিয়াঃ ৫০৫)
৬। ইবনে কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ জাদুর বাস্তবতা রয়েছে। কিছু জাদু এমন যে, তা দ্বারা মানুষকে হত্যা করা যায়, অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত করা যায়, স্বামীকে স্ত্রী সহবাসে অক্ষম করা যায় এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো যায়। (এরপর তিনি তাঁর কথার স্বপক্ষে কোরআন হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেন) [আল মুগনী, ১০/১০৬]
৭। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তাআলার বাণী— (হে নবী আপনি বলুন, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি) গিঁটে ফুৎকারকারী (জাদুকর) নারীদের অনিষ্ট থেকে। (সূরা ফালাক ৪) এবং আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহার প্রসিদ্ধ হাদীসটি প্রমাণ করে যে জাদুর প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর এটার বাস্তবতাও রয়েছে। ( বাদায়িউল ফাওয়ায়িদ, ২/২২৭)
অতএব জাদু সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন কোন বস্তু থেকে নিষেধ করতে পারেন না যার অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এতে বুঝা যায় যে যাদুর অস্তিত্ব আছে।