সমাজে প্রচলিত যাদু গুলোর মধ্যে একটি বশ করার যাদু। কাউকে বশ করা মানে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ একজন স্বকীয়ভাবে যা করত, তা করতে না দেওয়া কিংবা যা করত না, তা করিয়ে নেওয়া। সুতরাং বশ করার যাদু মানে হচ্ছে কাউকে নিজের প্রতি আসক্ত বা অনুগত করে ফেলা। এই যাদু সবচেয়ে বেশি করে বউরা। অনেক মহিলা স্বামীর ব্যাপারে সন্দেহ করে, সে বাহিরে গিয়ে অন্য কারো সাথে কোনো গুনাহ করছে কিনা! তখন কবিরাজ বাবার কাছে গিয়ে এই যাদু করে। অনেক সময় যে বশীভূত বা যাকে বশ করার যাদু করা হয়, সে বুঝতে পারে না যে বশ হয়েছে।
বশ করা যাদুর প্রমাণ
রাসূল সাঃ বলেছেন নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তামায়িম এবং তিওয়ালাহ শিরক। (আবু দাউদ:৩৮৮৩) এছাড়াও হাদীস টি মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজাহ হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে।
আর মুহাদ্দিসগণ বলেন তিওয়ালাহ অর্থ হচ্ছে আসক্ত করা। ইবনুল আছির রাহিমাহুল্লাহ বলেন – তিওয়ালাহ হলো এমন যাদু বা এমন বিষয় যা একজন স্ত্রীকে স্বামীর কাছে প্রিয় করে তোলে। আর এটি শিরক। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এটি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ভাগ্যের বিপরীতে প্রভাব ফেলে। (নিহায়া ১/২২২)
ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিওয়ালাহ হচ্ছে এমন বিষয় বা কর্ম যা কোনো তার স্বামীর ভালবাসা পাওয়ার জন্য বা স্বামীর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য করে থাকে। ইবনে হিব্বান এটি তার গ্রন্থ সহীহ ইবনে হিব্বান এ উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং উক্ত হাদীস থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে বশ করার যাদু করা এবং এবং তা স্পষ্ট শিরক এবং নাজায়েজ। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, এই যাদু শুধু গুনাহই না, ঈমানের জন্যও ক্ষতিকর! আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। কারো এরকম বিশ্বাস না থাকলেও এটি শিরক কারণ তা করা হয় যাদুর মাধ্যমে এবং জ্বীনের সহায়তায়।
উল্লেখ্য যে- পূর্ববর্তী হাদীছে যে রুকইয়াহ বা ঝাড়ফুঁক এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হল সেই রুকইয়াহ যাতে জিন ও শয়তানের সাহায্য চাওয়া এবং অন্যান্য বিষয় যা শিরকের সাথে জড়িত। অর্থাৎ কুফরী শিরকি তথা অবৈধ ও নাজায়েজ ঝাড়ফুঁক উদ্দেশ্য। আর কোরআন, দোয়া ও শরীয়ত সম্মত যিকির আযকারের মাধ্যমে রুকইয়াহ করা ফকীহদের সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয। সহীহ মুসলিমে এটা প্রমাণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ ঝাড়ফুঁক বা রুকইয়াহ’তে কোনো দোষ নেই যতক্ষণ তাতে শিরক না থাকে।” সহীহ মুসলিম ৫৬২৫, কিতাবুস সালাম।
এই যাদু যে শুধু স্ত্রীরাই করে এমন বরং যে কেউ-ই যে কাউকে এই করতে পারে। তবে এটা সাধারণত পরিচিতজনদের মাঝেই কেউ করে থাকে। কখনো সন্দেহপ্রবণ ও হিংসুক স্ত্রী করে, কখনো স্বার্থ হাসিল ও অর্থ-সম্পদের লোভে পুত্র, ভাই, চাচা-চাচী বা ভাবিরক্ত সম্পর্কের কেউ করে। এমনকি অনেক জাহেল মায়েরাও ছেলেকে বশে রাখার জন্য এই যাদু করে থাকে লোভ, সন্দেহ ও বউয়ের প্রতি হিংসাবশত।
শুধু তাই নয় এই যাদু দুজন প্রেমিক প্রেমিকারও যেকেউ করে থাকে। এই যাদুর সবচেয়ে জঘন্য ব্যবহার হচ্ছে, কোনো ছেলের যদি কোনও মেয়েকে পছন্দ হয় বা কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে তখন তাঁকে বিয়ে করার জন্যও এই যাদু করে। এই যাদু কখনো তাবিজের নামে, কখনো দোয়া-কালামের নামে ভণ্ড কবিরাজরা করে থাকে। সাধারণ মানুষ না বুঝে ঈমান আমলের ক্ষতি করে। আমরা বোঝার সুবিধার্থে আলোচনা স্বামী-স্ত্রী উল্লেখ করেই করবো, বাকিদের ক্ষেত্রে এ অনুযায়ী মিলিয়ে নিবেন।
মহব্বত বা বশ করার যাদুর লক্ষণ
১. বউয়ের প্রতি অতিরিক্ত আবেগ ও ভালোবাসা।
২. বেশি বেশি মিলনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
৩. ইহা থেকে বিরত থাকতে ধৈর্য্য ধরতে না পারা।
৪. তাকে দেখার অতি আগ্রহবোধ করা ও অস্থির হয়ে যাওয়া।
৫. স্ত্রীর অন্ধ আনুগত্য করা।
৬. সবসময় বউয়ের চিন্তা মাথায় ঘুরা, বাড়ির বাহিরে থাকতে পারেনা।
৭. বাড়িতে থাকলেও সারাদিন বউয়ের পিছেপিছে ঘুরা।
৮. স্ত্রীর কথা মনে পড়লেই যেখানে বিরক্ত ও অসহ্য লাগতো সেখানে হঠাৎ তার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা বৃদ্ধি পাওয়া।
৯. তার কোনো ভুল চোখে না পড়া বা ভুল করলেও কিছু বলতে না পারা।
১০. বুঝতে পারলেও অজানা কারণে নিজেকে তাঁর প্রতি বাধ্য থাকা।
১১. তার সব কথা ও সবকিছু সঠিক মনে হওয়া ও বিশ্বাস করা এবং অন্য সবাইকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করা।
আসক্তকারী যাদু কিভাবে করা হয়।
যখন কোনো নারী এজন্য যাদুকরের কাছে তখন যাদুকর সেই মহিলার কাছে তার স্বামীর কোনো নিদর্শন চায়; যা সে ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ যেটি নতুন বা অব্যবহৃত কিংবা ধোয়া নয়। বরং তা ব্যবহার করা হয় এবং ঘামের গন্ধ বহন করে। যেমন – রুমাল, টুপি , কাপড় , গেঞ্জি ইত্যাদি। অতঃপর তা থেকে সুতা নিয়ে মন্ত্র পড়ে তাতে ফুঁ দেয় এবং গিঁট দেয়। তারপর তাকে নির্জন স্থানে দাফন করার আদেশ দেয়। অথবা পানি বা খাবারের উপর যাদু করে থাকে খাওয়াতে বলে। এই যাদুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক হল অপবিত্রতার উপর যাদু করে, এবং এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হল- মাসিকের রক্তের উপর যাদু করে, স্ত্রী কে যাদুকর বলে যেন তার মাসিকের রক্ত নিয়ে আসে, রক্ত নিয়ে আসলে জাদু মন্ত্র পড়ে যাদুকর তাতে ফুঁ দিয়ে তাকে দেয় এবং তার স্বামীর খাবারে, পানীয় ইত্যাদিতে মিশিয়ে খাওয়ানোর নির্দেশ দেয়।
আসক্তকারী যাদুর বিপরীত প্রভাব
১ । কখনো যাদুর দ্বারা স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিন দিন শুকিয়ে যায়, শারীরিক সম্পর্কে অক্ষম হয়ে যায়, কেউ কেউ প্রায় পাগল হয়ে যায়। এমনকি রোগ দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ার কারণে কখনও মৃত্যুও ঘটে।
২। কখনো স্ত্রী তার স্বামীর জন্য এমন যাদু করে বসে যে, তার স্বামী যেন সব মহিলাকে ঘৃণা করে কেবল তাকেই ভালবাসে। যার ফলে সেই ব্যক্তি নিজের মা-বোন এমনকি স্ত্রীর মা-বোন ও আত্মীয় মহিলাদেরও ঘৃণা করতে থাকে।
৩. কখনো আবার ভালবাসার পরিবর্তে স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হতে থাকে। আর এটা এজন্য যে, কিছু যাদুকর যাদুর মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান রাখে না। এমনকি কেউ কেউ এজন্য বউকে তালাকও দিয়ে দেয়! এক্ষেত্রে কখনও কখনও এমন হয় যে, স্ত্রী তখন যাদুকরের যায় যেন সে যাদু নষ্ট করে দেয়। কিন্তু গিয়ে দেখে যে যাদুকর মারা গেছে। কথায় আছে যে অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে সে নিজেই তাতে পতিত হয়।
আসক্ত করার যাদুর কারণসমূহ
১. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মতভেদ ও মতবিরোধ:
সাধারণত প্রতিটি সংসারেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কিছুনা কিছু মতবিরোধ হয়েই থাকে। আবার তা খুব দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন চলতে থাকে। কিন্তু কতক মহিলা ধৈর্য্য ধারণ করতে পারে না। চিন্তা করে স্বামী কেন আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে। তারা চায় স্বামী কথামতো চলবে। তার সবকথা শুনবে মানবে। অথচ তারা স্বামীর কথামতো চলতে নারাজ। তিরা স্বামীর ওপর চরকি ঘুরাতে চায়। তখন তাদের মনে কুৎসিত চিন্তা ভেসে উঠে। মনে মনে ফন্দি আটতে থাকে, স্বামীকে যেভাবেই হোক আমার বশে আনতে হবে। সে শুধু আমার কথাই শুনবে, আমি যা বলবো তাই শুনবে, তাই করবে। আমার কথামতো চলবে। আমার কথায় উঠবে বসবে। এরজন্য যা করা দরকার আমি তাই করবো। এরপর সে কোনো যাদুকরের সন্ধান করতে থাকে। অথচ সে চিন্তাও করে না যে এ কাজটি কি ঠিক হব? ইসলাম কি এ কাজটি সমর্থন করে? হালাল নাকি হারাম? তার শুধু একটিই চিন্তা, কিভাবে স্বামীর ভালবাসা অধিক মাত্রায় আদায় করা যায়, কিভাবে স্বামী তাকে অধিক ভালোবাসবে। এর কারণ হচ্ছে মহিলার দ্বীনদারীর অভাব ও অজ্ঞতা এবং হিংসা।
২. স্বামীর সম্পদের প্রতি স্ত্রীর লোভ, অনেক সময় স্বামীর সম্পত্তির প্রতি লোভাতুর হয়েও স্ত্রী এই যাদু করে স্বামীকে। বিশেষ করে যদি স্বামী ধনি হয়ে থাকে।
৩. আবার অনেক সময় স্ত্রী ধারণা করে যে, স্বামী মনে হয় অন্যত্র বিয়ে করবে বা বিয়ে করেছে। ফলে স্বামী যেন অন্যত্র বিয়ে না করে বা করে ফেললেও শুধু তাকেই পছন্দ, তার কাছেই থাকে, এজন্য স্বামীকে বশে রাখার জন্য এই যাদু করে।
অথচ শরীয়তে তা জায়েয, তাতে কোন দোষ নেই; কিন্তু বর্তমান যুগের মহিলা বিশেষ করে ধ্বংসাত্মক মিডিয়া প্রভাবিত মহিলারা ধারণা করে থাকে যে, তাদের স্বামী অন্য বিবাহ করার অর্থ হলো সে তাকে ভালোবাসে না। এটি একটি মারাত্মক ভুল। কেননা এমন অনেক কারণ রয়েছে যার ফলে পুরুষ এক, দুই, তিন ও চার পর্যন্ত বিবাহ করে। অথচ দেখা যায় সে তার প্রথম স্ত্রীকেই বেশি ভালোবাসে। যেমনঃ কেউ অধিক সন্তান লাভের জন্য বা কেউ স্ত্রীর ঋতুস্রাব ও সন্তান প্রসবোত্তর স্রাবের সময় সহবাস না করে ধৈর্য ধরতে পারে না বা কেউ কোন বিশেষ পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়তে চায় বা আরো অনেক কারণ থাকতে পারে।
আসক্তকারী যাদুর রুকইয়াহ
প্রথমে পাক পবিত্র হয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে আপনার সমস্যার কথা বলে সুস্থতার জন্য প্রাণভরে দু’আ করুন, তারপর দরুদ ইস্তিগফার পড়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করুন।
১. সিহরের আয়াত গুলো প্রতিদিন দুইবার তিলাওয়াত করবেন।
২. প্রতিদিন সূরা তাগাবুন বিশেষ করে ১৪,১৫,১৬ নং আয়াত গুলো ২০/২৫ মিনিট করে বা যতবেশি সংখ্যকবার সম্ভব সকাল বিকাল দৈনিক দুই বার তিলাওয়াত করবেন।
৩. কোরআনে যেসকল আয়াতে মহব্বত সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেসব আয়াত প্রতিদিন দুইবার তিলাওয়াত করবেন।
৪. পাশাপাশি আয়াতুশ শিফা-সাকিনার আয়াত গুলো ও পড়তে পারেন।
৫. কেউ তিলাওয়াত করতে না পারলে বা পড়া শুদ্ধ না হলে এইগুলোর অডিও শুনবেন।
৬. সময় কম থাকলে সিহরের কমন আয়াত ও সূরা তাগাবুন তিলাওয়াত করবেন অন্তত এক ঘন্টা। কিংবা অডিও শুনবেন। বেশিসময় রুকইয়াহ করতে পারলে ভালো।
৭. চার পাঁচ লিটার পানি, কালোজিরা, অলিভ অয়েল, খাঁটি মধু নিয়ে সিহরের কমন আয়াত ও সূরা তাগাবুন কয়েকবার (৩/৭ বার) করে পড়ে এইগুলোতে তিনটি ফুঁ দিবেন।
তারপর গোসলের সময় এই পানি থেকে এক বা হাফ গ্লাস পানি নিয়ে গোসলের পানিতে মিশিয়ে গোসল করবেন।
আর প্রতিদিন তিন-চার বার বা যখনই পানি পানের প্রয়োজন হয় উক্ত পড়া পানি থেকে পান করবেন।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ও দিনে রাতে মিলিয়ে কয়েকবার অল্প অল্প করে কালোজিরা চিবিয়ে খাবেন।
আর দৈনিক কয়েকবার ব্যথার জায়গায় অলিভ অয়েল মালিশ করবেন।
৮. মাঝেমধ্যে একাধারে ৩/৭/১৪ দিন বরই পাতার গোসল করবেন। ( বরই পাতা গোসলের নিয়ম পরে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ)
লক্ষণীয়:
১. রুকইয়াহ করে পরিপূর্ণ ফলাফল পেতে অবশ্যই গানবাজনা শোনা যাবেনা। নামাজ-কালাম ঠিকঠাক পড়তে হবে। ফরজ ইবাদাতে যেন ত্রুটি না হয়। তথা শরীয়তের বিধিবিধান মেনে চলতে হবে।
২. বিশেষ করে পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে যে কাজটি করবেন সেটি হচ্ছে – অবশ্যই সকাল-সন্ধ্যার হেফাজতের মাসনুন আমল গুলো নিয়মিত স্থায়ীভাবে পালন করবেন।
৩. পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েকমাস লাগে পারে, তাই সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে রুকইয়াহ চালিয়ে যাবেন।
৪. সমস্যা জটিল হলে, জ্বীন থাকলে বা দুই এক মাস রুকইয়াহ’র পরও সমস্যা থাকলে রাকির কাছে সরাসরি রুকইয়াহ করুন।
৫. যেহেতু এই যাদু পরিচিতজনেরাই বা স্ত্রী করে থাকে তাই পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি যে বুঝতে পারছেন বা রুকইয়াহ করছেন সেটা তাদের থেকে গোপন রাখবেন।
উল্লেখ্য – উক্ত যাদুর রুকইয়াহ শুরু করার পূর্বে এক সপ্তাহ বদনজরের রুকইয়াহ নিবেন। যেকোনো সমস্যার জন্যই প্রথমে বদনজরের রুকইয়াহ নিলে ভালো।