বাচ্চা না হওয়া বা বন্ধ্যাত্বের জাদুর রুকইয়াহ

বর্তমানে অনেকেই এই সমস্যায় ভুগছেন। দিন দিন এই সমস্যা বেড়েই চলছে। অনেকেই জানেই না যে এই রোগের বাস্তবতা এবং মূল কারণ কি। আমরা আজকে এ নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই বন্ধ্যাত্বের সমস্যা হতে পারে। বন্ধ্যাত্ব প্রথমত দুই কারণে হতে পারে। ১ সৃষ্টিগত বা স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব, এর কোনো চিকিৎসা নেই। ২ কোনো রোগের কারণে অস্থায়ী বন্ধ্যাত্ব। এপ্রকার বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ভালো হওয়া সম্ভব।

সৃষ্টিগত বা স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব-

এ ব্যপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন –
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা চান, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা শূরা ৪৯-৫০)

যাদের এধরনের সমস্যা রয়েছে তাদের উচিত হচ্ছে আল্লাহর ফায়সালা ও তকদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকা এবং পুরষ্কারের আশা করা। আর ভাগ্যের প্রতি আপত্তি না করে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করতে থাকা। আল্লাহ তাআলা চাইলে নিয়ম ভেঙ্গেও সবকিছু করতে পারেন। যেমন আল্লাহ তাআলা যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কে বৃদ্ধ বয়সেও তার বন্ধ্যা স্ত্রীর গর্ভে সন্তান করেছিলেন। সুতরাং আপনিও মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে কাকুতি মিনতি করে দোয়া করতেই থাকুন এবং পুরস্কারের আশা করুন।

অস্থায়ী বন্ধ্যাত্ব:

অস্থায়ী বন্ধ্যাত্ব দুই কারণে হতে পারে। (১) শারীরিক মানসিক কোনো কারণে। এর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ডায়াগনোসিস করে মেডিকেল চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

(২) যাদুর কারণে বন্ধ্যাত্ব বা বারবার মিসক্যারেজ এর সমস্যা হতে পারে। কিংবা জ্বীন বা বদনজর হাসাদের কারণে। যদি জ্বীন যাদুর কারণে হয় তাহলে শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে রুকইয়াহ করতে হবে। এজন্য প্রথমে অভিজ্ঞ রাক্বীর সরণাপন্ন হয়ে ডায়াগনোসিস করে নিতে পারেন।

এই ধরনের যাদুর প্রমাণ হাদিসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে: আসমা বিন্‌ত আবূ বক্‌র (রাঃ)‎ থেকে বর্ণিতঃ: তিনি ‘আবদুল্লাহ্‌ ইবনু যুবায়রকে মক্কায় গর্ভে ধারণ করেন। তিনি বলেন, গর্ভকাল পূর্ণ হওয়া অবস্থায় আমি বেরিয়ে ‎মদীনায় আসলাম এবং কুবায় অবতরণ করলাম। কুবাতেই আমি তাকে প্রসব করি। তারপর তাকে নিয়ে রসূলুল্লাহ্‌ ‎‎(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে তাকে তাঁর কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনতে ‎বললেন। তা চিবিয়ে তিনি তার মুখে দিলেন। রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই লালাই সর্বপ্রথম ‎তার পেটে প্রবেশ করেছিল। তারপর তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহ্নীক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দু’আ ‎করলেন। (হিজরতের পরে) ইসলামে জন্মলাভকারী সেই ছিল প্রথম সন্তান। তাই তার জন্যে মুসলিমরা মহা আনন্দে ‎আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ, তাদের বলা হত ইয়াহূদীরা তোমাদের যাদু করেছে, তাই তোমাদের সন্তান হয় না।(আধুনিক প্রকাশনী- , ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৯৬০) সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪৬৯
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গর্ভনিরোধ বা গর্ভপাতের উপর জাদুর প্রভাব থাকতে পারে, অর্থাৎ জাদুর কারণে বন্ধ্যাত্ব বা মিসক্যারেজ হতে পারে।

পুরুষের বন্ধ্যাত্ব-

চিকিৎসকদের মতে, প্রতি মিলিলিটারে শুক্রাণুর সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটির কম হলেই প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। তাই সন্তান জন্মদানে সক্ষম হওয়ার জন্য একজন পুরুষের এক মিলিলিটার বীর্যে ১৫ মিলিয়নেরও বেশি শুক্রাণু থাকা জরুরী। আর এই শুক্রাণু পুরুষের অন্ডগকোষ থেকে বীর্যে নিক্ষেপিত হয়। জ্বীন অধিকাংশ সময় অন্ডকোষে চাপ সৃষ্টি করে বা অন্য কোনো ভাবে বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা পূর্ণ হতে দেয় না। ফলে সেই বীর্য সন্তান জন্মদানের যোগ্যতা হারায়।

শুক্রাণু জীবিত থাকার জন্য একধরনের লালাজাতীয় খাবারের প্রয়োজন হয়। তা একধরনের পিচ্ছিল প্রবাহমান পদার্থ। যা গোশত থেকে প্রবাহিত হয়। যখন শুক্রাণু অন্ডকোষ থেকে স্থানান্তরীত হয়ে বীর্যথলির দিকে যায় তখন এই পিচ্ছিল পদার্থ গোশত থেকে প্রবাহিত হয়ে শুক্রাণুমিশ্রিত বীর্যের চলে যায়। তো জ্বীন কখনো কখনো সেই পিচ্ছিল পদার্থ কে শুক্রাণু মিশ্রিত বীর্যের কাছে যেতে বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে শুক্রাণু খাবার না পেয়ে মারা যায়। এতে পুরুষের বীর্য সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারায়।

কখনো কখনো জ্বীন যেকোনো পন্থা অবলম্বন করে শুক্রাণুগুলোকে এতটাই দুর্বল করে দেয় যে যেন এইগুলো ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাতে পারে না বা ডিম্বাণুর আবরন ভেদ করে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না। যার ফলে নারীর গর্ভধারণ হয়না।

নারীর বন্ধ্যাত্ব

জ্বীন বিভিন্ন পন্থায় নারীর প্রজনন ক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়। বা ডিম্বাণু তৈরি হতে বা জরায়ুতে সঠিকভাবে নিঃসরণ হতে বাধা সৃষ্টি করে। কিংবা ডিম্বাণু মেরে ফেলে। যার ফলে অনেক নারীদের PCOS এর সমস্যা দেখা দেয় বা ওভারিতে সিস্ট হয়ে যায়।

অথবা প্রাথমিকভাবে কিছু করে না বরং নিষিক্ত সম্পূর্ণ না হওয়া বা গর্ভধারণ না করা পর্যন্ত এবং গর্ভাবস্থা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিন্তু গর্ভধারণের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পরে জ্বীন জরায়ু বা জরায়ুর রগে আঘাত করে। ফলে রক্তক্ষরণ বা ব্লিডিং শুরু হয়ে যায় এবং তার গর্ভ নষ্ট হয়ে যায় বা গর্ভপাত হয়ে যায়। আর এটাকেই আমরা বলি যে তার ব্লিডিং হয়ে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত হয়ে গেছে।

বন্ধ্যাত্ব যাদুর লক্ষণসমূহ-

১. মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা থাকা, বিশেষত বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
২. কোমরে বা মেরুদন্ডের নিচের দিকে ব্যথা করা।
৩. অধিক পরিমাণে ভুলে যাওয়া।
৪. বেশিবেশি মতিভ্রম হওয়া।
৫. প্রায়ই মাথাব্যথা করা।
৭. বুকে ভারি বা যন্ত্রণা অনুভব করা।
৮. তলপেটে ব্যথা অনুভব করা।
৯. ঘুমের মাঝে অস্থিরতা, ঠিকভাবে ঘুমাতে না পারা।
১০. ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখা
১১. অনিয়মিত পিরিয়ড।
১২. পিরিয়ডের সময় বমি ভাব হওয়া বা মাথা ঘুরা।
১৩. সহবাসের সময় ব্যথা অনুভব করা।
১৪. ঘনিষ্ঠ হলে নারীর ব্লিডিং শুরু হয়ে যাওয়া।
১৫. স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে স্বামীর অক্ষমতা।
১৬. বারবার মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়া।
১৭. কনসিভ না হওয়া। চিকিৎসা করেও ফায়দা না হওয়া।
১৮. আসরের পর প্রচন্ড ঘুম পাওয়া।
১৯. হায়েজ বন্ধ হওয়ার পর থেকে ১০/১৫ দিন বা কনসিভ করার সময় গুলোতে প্রায় রাতেই দুজনের মধ্যে ঝগড়া হওয়া। যার ফলে আর ওই দিন গুলোতে তেমন বেশি একসাথে থাকা হয়না।

বন্ধ্যাত্ব যাদুর রুকইয়াহ

প্রথমে পাকসাফ হয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুন। এরপর আল্লাহর কাছে আপনার সমস্যার কথা বলে প্রাণভরে দু’আ করুন, তারপর দরুদ ইস্তিগফার পড়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করুন।

প্রেসক্রিপশন:
১. সিহরের আয়াত গুলো প্রতিদিন দুইবার তিলাওয়াত করবেন।
২. কোরআনে যেসমস্ত আয়াতে গর্ভ সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেসব আয়াত প্রতিদিন দুইবার তিলাওয়াত করবেন।
৩. প্রতিদিন সকালে সুরা সফফাত পড়বেন, নইলে অন্তত শুনবেন।
৪. প্রতিদিন রাতে সুরা মা’আরিজ পড়বেন, নইলে অন্তত শুনবেন।
৫. কারো পক্ষে তিলাওয়াত করা সম্ভব না হলে এই রুকইয়াহ গুলোর অডিও শুনবেন।
৬. বেশি বেশি সূরা ফালাক নাস ও আয়াতুল কুরসি পাঠ করবেন।
৭. শরীরে জ্বীন আছে বুঝতে পারলে এগুলোর সাথে সূরা বাকারাহ ও আট সূরা রুকইয়াহ পাঠ করবেন। বা জ্বীন আছরের রুকইয়াহ করবেন।

রুকইয়াহ সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার

সাপ্লিমেন্ট তৈরি-
প্রথমে হাতের কাছে পরিমাণ মতো কালোজিরা, কালোজিরা তেল, মধু ও পানি নিন। এরপর সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, বাক্বারার শেষ রুকু, আলে ইমরানের শেষ রুকু, ফালাক্ব, নাস সম্ভব হলে গর্ভ সংক্রান্ত আয়াত ও উপরে উল্লেখিত রুকইয়াহ’র সকল আয়াত ও সূরা পড়ে এইগুলোতে তিনটি ফুঁ দিন।

ব্যবহার পদ্ধতি-
এরপর এই কালোজিরার তেল প্রতিদিন ঘুমানোর আগে বুকে, তলপেটে, কপালে, এবং মেরুদণ্ডে মালিশ করবেন।
২. এই মধু থেকে ১ চামচ করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ও রাতে ঘুমের আগে খাবেন।
৩. প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ও রাতে ঘুমের আগে বা যতবার ইচ্ছা অল্প কিছু কালোজিরা হাতে নিয়ে খাবেন।
৪. প্রতিদিন তিন-চার বার বা যখনই পানি পানের প্রয়োজন হয় এই পড়া পানি থেকে পান করবেন।
৫. সাপ্লিমেন্ট গুলো শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন করে পড়ে নিবেন।

রুকইয়াহ গোসল-

১. পান করার জন্য তৈরি করা পড়া পানি থেকে আধা গ্লাস বা এক গ্লাস পানি নিয়ে গোসলের পানিতে মিশিয়ে গোসল করবেন। এভাবে প্রতিদিন গোসল করবেন, বা যেদিন গোসল করবেন সেদিন এভাবে রুকইয়াহ’র গোসল করবেন।

২. মাঝেমধ্যে একাধারে ৩/৭/১৪ দিন বরই পাতার গোসল করবেন। ( বরই পাতা গোসলের নিয়ম পরে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ)

লক্ষণীয়:
১. রুকইয়াহ করে পরিপূর্ণ ফলাফল পেতে অবশ্যই গানবাজনা শোনা যাবেনা। নামাজ-কালাম ঠিকঠাক পড়তে হবে। ফরজ ইবাদাতে যেন ত্রুটি না হয়। পর্দা করতে হবে; মাহরাম ও নন মাহরাম মেনে চলতে হবে। তথা শরীয়তের বিধিবিধান মেনে চলতে হবে।
২. সমস্যা ভালো হতে ৩ মাস পর্যন্ত লাগতে পারে, ধৈর্য ধরে চালিয়ে যেতে হবে। রুকইয়ার সময় অনেক কষ্ট হলেও বাদ দিবেন না।
৩. কয়েকদিন করেই যদি ভালো ফিল করতে লাগেন, তখন বাদ দিয়ে দিবেন না। বরং আরও দুই-এক সপ্তাহ রুকইয়া চালিয়ে যান।
৪. কারো যদি জ্বীন জাদুর সমস্যা না থাকে বরং মেডিক্যাল সংক্রান্ত কোনো কারণে বাচ্চা হচ্ছে না তাহলে মেডিকেল চিকিৎসার পাশাপাশি রুকইয়াহ করতে পারেন। খুব বেশি উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।
৫. বিশেষ করে পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে যে কাজটি করবেন সেটি হচ্ছে- নতুন করে যেন জাদু করতে না পারে বা করলেও তা কার্যকর না হয়, জ্বীন যেন কিছু করতে না পারে সেজন্য অবশ্যই সকাল-সন্ধ্যার হেফাজতের মাসনুন আমল গুলো নিয়মিত পালন করবেন।

শেয়ার করুন -

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top