ই
পবিত্র কোরআন ও হাদিস থেকে জানা যায়, কুদৃষ্টি বা বদনজর লেগে যাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত সত্য।
মানুষের চোখ লাগা (কুদৃষ্টি) এবং এর ফলে অন্য মানুষ বা জন্তু-জানোয়ারের ক্ষতি হওয়া সত্য। এটা মূর্খতাসুলভ কুসংস্কার নয়। তবে বদনজর থেকে মুক্তি বা বাঁচার জন্য সমাজে যে সব পদ্ধতি প্রচলিত আছে সেগুলোর অধিকাংশই কুসংস্কার ও শয়তানী কর্মকাণ্ড। যেমন ছোট বাচ্চাদের কপালে টিপ দেওয়া, আঙ্গুল কামড়ে দেওয়া, মরিচ ও পানপাতা কিংবা কলাপাতা ইত্যাদি পেটে লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, ঘর-বাড়ি সোনা-রুপার পানি দিয়ে ধৌত করে দেওয়া, গাছে জুতা ঝুলিয়ে রাখা। ফলের গাছ বা ফসলের ক্ষেতে কারো ‘নজর লেগে যাওয়ার’ ভয়ে মাটির পাতিলে চুনা লাগিয়ে টানিয়ে রাখার প্রথাও গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে।
এগুলোর কোনটাই শরীয়তসম্মত পদ্ধতি নয়। সবই কুসংস্কার এবং মারাত্মক গোনাহের কাজ। যদিও এগুলো বদনজর রোধ করার ইসলামসম্মত পদ্ধতি নয়। তথাপি বদনজর লাগার বিষয়টিও একেবারেই অবাস্তব বা কুসংস্কার নয়। বাস্তবিক অভিজ্ঞতাকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান দিয়ে মাপা যায় না। কোরআন সুন্নাহ কে নিজেদের জ্ঞান ও যৌক্তিকতা দিয়ে বিচার করা যাবে না। বরং যেকোনো ক্ষেত্রে কোরআন সুন্নাহ দিয়ে নিজেদেরকে যাচাই করতে হবে। কোরআন সুন্নাহ যা বলে সেটা আমাদের সাধারণ জ্ঞানে না ধরলেও বিশ্বাস করতে হবে, মানতে হবে এবং নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ধীরে ধীরে আমরা বদনজর হাসাদ জ্বীন ও যাদুটোনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, এবং আলোচনা করবো কিভাবে শরীয়তসম্মত উপায়ে এ সমস্ত ক্ষতিকর বিষয় মুক্ত ও সুস্থ থাকা যায়। কিভাবে নিজেরাই কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী বদনজরের রুকইয়াহ চিকিৎসা করে সুস্থ থাকতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ।
১. বিভিন্ন পরিস্থিতি পরিবেশে অনেকেই বলাবলি করে যে বদনজর বলতে কিছু নেই। ভাই, আপনি কি বদ-নজরে বিশ্বাস করেন?’ ‘ভাই, বদ-নজর বলে আদৌ কি কিছু আছে?
অথচ তারা জানেই না ইসলামে বদনজর সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে কিনা এবং জানার চেষ্টাও করে না। আর এই না জানাকে তারা মনেও করে না যে এটা তাদের জ্ঞানের কমতি। বরং এই অজ্ঞাতাকেই মানুষের কাছে ফেরি করে বেড়ায় এবং আরো অনেককেই বিভ্রান্ত করে এভাবে। এটা যে শুধু বদনজরের ক্ষেত্রে তা নয়, বরং দ্বীনের অনেক বিষয়েই কিছু মানুষ নিজের না জানাকে অজ্ঞতা মনে না করে বরং সঠিক মনে করে ভুল প্রচার করে বেড়ায়।
মনে রাখবেন, ইসলামে কু-সংস্কারের কোন স্থান নেই। যেমন গ্রামগঞ্জে মানুষ বিশ্বাস করে— কোথাও যাওয়ার পথে কালো দোয়েল পাখি দেখলে সে যাত্রা শুভ হয় না। বাড়ির ওপরে এসে ভর-দুপুরে কাক ডাকা মানে আসন্ন কোন বিপদের পূর্বাভাস। কোন কাজে যাওয়ার জন্য বেরুতে গিয়ে যদি হোঁচট খায়, তাহলে কাজটা ভালো না হওয়ার ইঙ্গিত। কিছু ভুলে ঘরে বা বাসায় রেখে গেলে সেটা নিতে আসলে ঘরে প্রবেশ না করে বরং অন্য কারো মাধ্যমে আনিয়ে ঘরের বাহির থেকেই নেওয়া।
এমনসব কু-সংস্কারে পরিপূর্ণ আমাদের গ্রাম্য-সমাজ। এ-জাতীয় কোন উদ্ভট ব্যাপারে ইসলামের কোন সমর্থন নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো তো কু-সংস্কার বটেই, কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলো শিরক আর কুফরের মধ্যেও মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
কিন্তু বদ-নজর সেরকম নয়। কুরআন এবং হাদিসে এটার পক্ষে যথেষ্ট দলীল পাওয়া যায়। এখানে শুধু দুটি দলিল উল্লেখ করছি।
সূরা ইউসুফের ৬৭ নম্বর আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম যখন তাঁর পুত্রদের মিশরে পাঠাচ্ছিলেন, তখন বাড়তি করে বলে দেন যে— ‘
এবং (সেই সঙ্গে একথাও) বলল যে, হে আমার পুত্রগণ! তোমরা শহরে প্রবেশকালে সকলে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না; বরং ভিন্ন-ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহর কোন বিধান থেকে আমি তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারি না, আল্লাহর নির্দেশই কেবল কার্যকর হয়। তাঁরই উপর আমি ভরসা করি, আর ভরসাকারীদের তাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত ।” (সুরা ইউসুফ আয়াত ৬৭)
ইবনে আব্বাস রা. ইমাম মুজাহিদ রহ. কাতাদাহ রহ. সহ সকল মুফাসসিরকারকগণ নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ‘এক দরোজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং ভিন্ন ভিন্ন দরোজা দিয়ে প্রবেশ করবে’— এই কথার ব্যাখ্যায় বলেছেন যে— ছেলেদের ব্যাপারে তিনি বদ-নজরের আশঙ্কা করেছিলেন। কারণ নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সকল সন্তানেরাই ছিলো অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, সুঠাম দেহের অধিকারী এবং অধিকন্তু অত্যন্ত সু-দর্শন। লোকজন যখন জানবে যে এই সবগুলো (ইউসুফ আলাইহিস সালাম ব্যতীত বাকি এগারোজন) একই পিতার সন্তানাদি, তখন বদ-নজর লেগে যেতে পারে। তাই ইয়াকুব আলাইহিস সালাম আগ থেকেই সন্তানদের সাবধান করে দিয়েছেন। পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করে দিয়েছেন ‘এসব (বদনজর) তো আসলে আল্লাহর তৈরি সিস্টেম, এখানে আমার কিছু করার নাই.. আল্লাহর ওপর ভরসা ছাড়া!” পরিশেষে তা তাদের জন্য বদনজর হতে প্রতিরোধক হিসেবেই আল্লাহর হুকুমে কাজ হয়েছিল——- সংক্ষিপ্ত । (তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ২/৪৮৫)
(বিস্তারিত জানতে তাফসীরে ইবনে কাসির অথবা বয়ানুল কোরআনে আয়াতের প্রাসঙ্গিক আলোচনা দেখা যেতে পারে..)
কুরআনের এই আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে— বদ-নজর সত্য ও বাস্তব, তা কোন কু-সংস্কার নয়। তাছাড়া নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো হাদিসে বদ-নজরের ব্যাপারে বলা আছে। তন্মধ্যে বুখারীর একটা হাদিসে সরাসরিই আছে, রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— ‘বদ-নজর সত্য। (বুখারী- ৫৭৪০, ৫৯৪৪, মুসলিম- ৫৫৯৪) তার মানে হলো— বদ-নজর লাগে। এর প্রভাব আছে।
২. বদ-নজরের সাধারণ কারণ হলো মুগ্ধতা ও হিংসা। কোনো ভালো কিছু দেখে মুগ্ধ হওয়া, প্রশংসা করা বা হিংসা করা। অর্থাৎ— কারো কোন সফলতা, ভালো গুণ, প্রাচুর্য, প্রাপ্তি কিংবা লাভ দেখে যখন অন্যকেউ তার প্রতি মুগ্ধ হয় বা তাকে হিংসা করে, তখন ওই ব্যক্তি যে কোনোকিছু লাভ করেছে, তার ভালো গুণ বা বস্তু রয়েছে, তার ওপরে নজরদাতা বা হিংসা-কারীর বদ-নজর লাগতে পারে। তবে— হিংসা-কারী যে ওই ব্যক্তির ক্ষতি চায় বলেই বদ-নজর লাগে তা নয়, বরং ওই প্রাপ্তি দেখে তার মধ্যে সেটা লাভের জন্য যা হাহাকার তৈরি হয়, সেই হাহাকার থেকেই বদ-নজরের উৎপত্তি।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে- তার মানে কি, আমরা কারো কোনো কিছু দেখবো না? চোখ বন্ধ করে রাখবো? কোন প্রাপ্তির সংবাদ, কারো ভালো কোনোকিছু সম্পর্কে জানতে চাইতে পারবো না? বা বললে কি শুনতে পারবোনা?
ব্যাপারটা তা নয়। অবশ্যই কারো সফলতা, কোন ভালো অর্জন, প্রাপ্তি বা লাভ সম্পর্কে আমরা জানতে পারবো, তবে সেই অর্জন আর প্রাপ্তির কথা শোনার সাথে সাথে বদনজর যেন প্রাভাব না ফেলে সেজন্য কোরআন-হাদিসে বর্ণিত প্রটেকশন বা সেফটি গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ আমরা আল্লাহর প্রশংসা পাঠ করবো, তার জন্যে দুয়া করে দেবো। তাহলে আর আমাদের বদ-নজর লাগবে না, ইন শা আল্লাহ।
আর মুগ্ধতা ও প্রশংসা থেকেই যেহেতু বদনজর লেগে যায় সেহেতু নিজের ওপর নিজের বদনজরও লাগতে পারে, নেক-কার ব্যক্তির নজরও লাগতে পারে। তাই সফলতা, কোন ভালো কিছু অর্জনকারী বা ভালো গুণের অধিকারী ব্যক্তিও অন্যের ও নিজের বদনজর থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে ও বরকতের দুআ করতে হবে।
৩. আশাকরি উপরের আলোচনা থেকেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝে গেছেন। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এরপরও কারো মনে একটু খুঁতখুঁতানি, একটু আমতা আমতা ভাব অবশিষ্ট থেকে যেতে পারে। যারা ভাবছেন, ‘কিন্তু, বদ-নজর ধর্মে আছে মানলাম, এটার ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে?’ এই অংশটা তাদের জন্য।
প্রথমেই বলে নিই— আল্লাহ তাআলার কিতাব আল কুরআন এবং রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে যখন স্পষ্টভাবে দলিল আছে, সেটা মেনে নেওয়ার জন্যে তখন কোন মুমিন ব্যক্তির মনেই আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ‘ইয়ে-যদি-তবে-কিন্তু’ থাকা উচিত নয়। আমাদের হতে হবে আবু বাকার রাদিয়াল্লাহু আনহু ও খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার মতোন মুসলিম। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বলেছেন? ব্যস! কুরআনের ভাষায়— সামি’না-ওয়া আতা’না- অর্থাৎ ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’।
এরপরও যদি আপনার মানতে কষ্ট হয় বা মনে ‘তবে-যদি-কিন্তু’ থেকে যায় তাহলে বলবো, যখন আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হবে তখন হয়তো বিশ্বাস করবেন। কিংবা অর্থনৈতিক, শারীরিক মানসিক ক্ষতি, বিষণ্নতা, পেরেশানি আপনারই হবে এতে আল্লাহ তাআলা ও তার দ্বীনের বিন্দুমাত্র ক্ষতিও হবেনা।
আরিফ আজাদ হাফিজাহুল্লাহ একটি প্রবন্ধে বলেছেন – কিছুকাল আগ অবধিও এই ‘বদ-নজর’ তথা ‘ইভিল-আই’কে পশ্চিমা দুনিয়াতে ‘কু-সংস্কার’ জ্ঞান করা হতো। কিন্তু, ২০১০ সালে Collins A. Ross নামের একজন রিসার্চার Evil-Eye এর উপরে গবেষণা করে বলেছেন— বদ-নজর কু-সংস্কার নয়, এটার সাইন্টিফিক কারণ আছে। এটার উপরে তিনি একটা রিসার্চ পেপার তৈরি করেন ‘Electrophysiological basis for the Evil-Eye belief’ শিরোনামে। ‘Anthropology of Consciousness’ নামক জার্নালে সেটা প্রকাশিত হয়।
কিন্তু বিজ্ঞান এটা নিয়ে কী বললো, কী করলো তা মূল ব্যাপার নয়। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যা বলেছেন তা-ই আমাদের জন্য বিশ্বাস, তা-ই আমাদের জন্য দ্বীন।
আমাদের সকলকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বোঝার তাওফীক দান করুন এবং বদ-নজর থেকে হেফাযত রাখুন।